জিয়া ও খালেদা জিয়াকে কটূক্তি : সংসদে হট্টগোল : ওয়াকআউট : মানুষ ঘন ঘন লোডশেডিং সহ্য করবে আর সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এটা সম্ভব নয় : মেনন : দ্রুত বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন একটি ফটকাবাজির ব্যবসা : বিএনপি শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়েছে এ কথা সত্য : আবদুর রাজ্জাক
সংসদ রিপোর্টার
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য ও কটূক্তি ও রাষ্ট্রপতির ভাষণের আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্যকে সময় বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদে গতকাল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছে বিএনপি। রাত সোয়া ৭টার দিকে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর সভাপতিত্বের সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনার সময় এ ওয়াকআউটের ঘটনা ঘটে। ওয়াকআউটের আগে বিএনপির সিনিয়র সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ারসহ সব এমপি একযোগে দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানান ও প্রতিবাদ করেন। তারা ডেপুটি স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, আপনি সংসদ অকার্যকর করেছেন। দুয়েকজন ফাইলও ছুড়ে মারেন। এ সময় সংসদে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে বিরোধী দল ওয়াকআউট করলে সরকারি দলের সদস্যরা টেবিল চাপড়ান। এ সময় সরকারি দলের শাহ আলম বক্তব্য রাখছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। এরপর সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে তাত্ক্ষণিক এক ব্রিফিংয়ে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, দুই দলের পরস্পরকে আক্রমণ ও অশালীন বক্তব্য দেয়ার ব্যাপারে স্পিকারের রুলিং সরকারি দলের এমপিরা মানেননি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা ওয়াকআউট করেছি।
গতকাল মাগরিব নামাজের বিরতির পর রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আলোচনায় বিএনপির সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনির বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাজমা আক্তার বক্তব্য দিতে গিয়ে ‘পাক সেনাবাহিনীর মেহমানদারি করেন খালেদা জিয়া’, ‘জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনি’, ‘তারেক-কোকো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ’ ইত্যাদি মন্তব্য করেন। এই বক্তব্যের সময় বিএনপির সংসদ সদস্যরা তীব্র হৈচৈ করে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। পরে নাজমা আক্তারের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই বিরোধীদলীয় সদস্যরা তার বক্তব্যের বিতর্কিত অংশ এক্সপাঞ্জ করার দাবি তোলেন। কিন্তু ডেপুটি স্পিকার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা ৭টা ১৬ মিনিটে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন।
এদিকে গতকাল সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের শরিক দলের সদস্যরা দ্রব্যমূল্যসহ জনজীবনের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে সরকারকে সতর্ক করে দেন। তারা বলেন, সরকারকে মনে রাখতে হবে চালের মূল্য সরকার উত্থান-পতনের সূচক। ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে আর মানুষ সন্তুষ্ট থাকবে এটা হতে পারে না। মানুষের সমস্যার সমাধান না করা গেলে বিরোধী দল এটাকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে।
সরকারদলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। ভারত, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমানের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরাই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সবচেয়ে কম। আজ জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন। আপনারা আগেও ক্ষমতায় ছিলেন। আগামীতেও ক্ষমতায় আসবেন, দেশ চালাবেন। এটা মনে রেখে কথাগুলো বলতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচার অবশ্যই হবে। যত দ্রুত সম্ভব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী (সংসদে) থাকলে ভালো হতো। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির কথা বলা হচ্ছে। কেলেঙ্কারি হয়েছে এ কথা সত্য। এজন্য মধ্যবিত্ত-পেনশন ভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য আগেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ কারণে আস্তে আস্তে বাজার উঠতে শুরু করেছে।
বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সারা পৃথিবীতে আমাদের বদনাম হয়ে গেছে। আমরা সংসদ বর্জন করছি। আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাই সংসদে থাকুন। সংসদে এসে ওয়াকআউট করুন তারপরও সংসদে আসুন। বর্তমানে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত করে ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, দুদিন আগে যারা সংসদের আসন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতেন, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির জন্য কান্নায় রুমাল ভেজাতেন আজ তারা হঠাত্ করে এত শক্ত কথা কীভাবে বলছেন। বিরোধী দল গণতন্ত্র নস্যাত্ করার জন্য নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। তারা গণতন্ত্রকে হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্যই নানা ষড়যন্ত্রমূলক কথা বলছেন।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে বিএনপি-আওয়ামী লীগ নয়, আছে লুটেরাদের দল। তারা জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। লুটেরাদের দল নেই। মধ্যবিত্তদের পুঁজি ছিনিয়ে নিয়েছে।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গ তুলে ধরে জোটের অন্যতম শরিক মেনন বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা কথা দিয়েছিলাম দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা হবে। কিন্তু দুই বছরে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধিতে মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। ফেয়ার প্রাইজ এবং ওএসএম যথেষ্ট নন। অর্থমন্ত্রী সিন্ডিকেট দেখেন বাণিজ্যমন্ত্রী দেখেন না। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
তিনি বিদ্যুত্ সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধান হয়নি। জরুরি বিদ্যুত্ সরবরাহের জন্য সরকার যে পিকিংপাওয়ার প্লান্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সফলতা আসবে না। মানুষ ঘন ঘন লোডশেডিং সহ্য করবে আর সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এটা সম্ভব নয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটা করতে না পারলে বিদেশিদের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে।
সংসদে উত্থাপিত দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন আইনের বিরোধিতা করে মেনন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুদক রাজনীতিবিদদের দমনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তার মানে এই নয়, এটাকে আমরা ছুরিকাঘাত করে দেব। সংসদের উচিত হবে এটার অনুমোদন না দেয়া। সরকার দলের নেতাকর্মীদের দলবাজি, টেন্ডারবাজির সমালোচনা করে তিনি বলেন, দলবাজি, দলীয়করণ কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। বিএনপি করেছে বলে আমাদের করতে হবে, এ যুক্তি ধোপে টেকে না। এসবের বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, মহাজোট সরকার দু্’বছরে নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করার চেষ্টা করছে। কোথাও খাদ্য সঙ্কট নেই। বিশ্বায়নের যুগে দ্রব্যমূল্য কিছুটা বাড়বেই। তবে সরকার দরিদ্রদের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করছে। শক্তিশালী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আর সরকারের সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচিত সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব।
বিএনপির বেগম নিলোফার চৌধুরী মনি দ্রব্যমূল্য, পানি, বিদ্যুত্, গ্যাসসহ জনজীবনের সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, সরকারের অবস্থা ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই, কিল দেয়ার গোসাই’য়ের মতো। দ্রুত বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন একটি ফটকাবাজির ব্যবসা।
সরকারের সর্বত্র ‘নেই নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি নেই, ১০ টাকায় চাল নেই। বিনামূল্যে সার নেই। ঘরে ঘরে চাকরি নেই। মহাজোটে শান্তি নেই। শেয়ারবাজারে টাকা নেই। মা-বোনের ইজ্জত নেই। আইনের শাসন নেই। ছাত্রলীগের অভিভাবক নেই। যুবলীগের টেন্ডারবাজির জুড়ি নেই। বর্ষীয়ান নেতাদের মূল্যায়ন নেই। শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি নেই। দুদক আছে ক্ষমতা নেই। আওয়ামী লীগের কর্মীদের নামে মামলা নেই। বেগম জিয়ার নামে মিথ্যা মামলা আছে, শেখ হাসিনার নামে মামলা নেই। সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যার বিচার নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের চিহ্ন নেই।
আওয়ামী লীগের নাজমা আক্তার বলেন, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা বলছেন, নেই নেই নেই। আসলে সবকিছুই আছে, শুধু বিরোধীদলীয় নেতার অবৈধ বাড়ি নেই। তিনি বলেন, বিরোধী দলীয় নেতা সব অবৈধ বলেন। তিনি নিজেই অবৈধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম জিয়া পাকহানাদার বাহিনীর সেনা শাসকদের মেহেমানদারিতে ব্যস্ত ছিলেন। জিয়া যখন ঘরে নিতে চায়নি, তখন বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছে কান্নাকাটি করেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধ বেগম জিয়াকে সংসার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে নকল জন্মদিন পালন করে সম্মান দেখানোর কথা বলেন। নাজমা আক্তার তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত বলে অভিযোগ করেন।
বিএনপির আমজাদ হোসেন বলেন, দলের মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে আয়োজিত মিলাদ মাহফিল ও শোক শোভাযাত্রায় পুলিশ হামলা করেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের পিটিয়ে জখম করেছে। হামলা-মামলা, খুন, ধর্ষণ আর জিনিসপত্রের দামের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনি যদি আপনার ভাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাহলে বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম মাঠে মারা যাবে। নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বলেন, দু’বার হামলার শিকার হয়েছি। একজনও গ্রেফতার হয়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তার এলাকায় ডাকাতি ও অসামাজিক কাজ চলছে। জেলা পুলিশ সুপারের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের তাজুল ইসলাম, শাহ আলম, বিএম মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেফালী মমতাজ, সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, সাধন চন্দ্র মজুমদার, বিএনপির আমজাদ হোসেন, জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা প্রমুখ।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের ব্রিফিং : নেতানেত্রীদের সম্পর্কে অশোভন উক্তি করে সরকার সংসদকে অকার্যকর করতে চায় বলে অভিযোগ করেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। একইসঙ্গে তিনি বিরোধী দল সংসদে থাকুক তা চান না বলে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন।
গতকাল সংসদের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সরকারি দলের একজন মহিলা সংসদ সদস্য আমাদের নেতা শহীদ জিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে অশোভন বক্তব্য রাখার পরও ডেপুটি স্পিকার সময় আরও বাড়িয়ে দেন। আমরা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরও আমাদের ফ্লোর দেননি। তিনি আমাদের দেখেও দেখেননি।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, রেহেনা আক্তার রানু, সৈয়দা অসিফা আশরাফী পাপিয়া, শাম্মী আখতার, নিলুফার চৌধুরী মনি, রাশেদা বেগম হীরা, শেখ সুজাত মিয়া প্রমুখ।