বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি—০১
সৈয়দ আবদাল আহমদ
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেননি। তাজউদ্দীন আহমদ ওই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণার ছোট্ট একটি খসড়া তৈরি করে টেপরেকর্ডারে ধারণ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পড়তে দেন। বঙ্গবন্ধু খসড়াটি পড়ে নিরুত্তর থাকেন এবং এড়িয়ে যান। তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণাটি দিতে অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটি দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ ইপিআর সিগন্যালসের মাধ্যমে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন সেটাও বোধহয় অবাস্তব কথা। চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন বলে যে কথা বলা হয়, তাও সঠিক নয়। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছে যে, স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান কাউকে কিছু বলে গেছেন কিনা। এর মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীও ছিলেন। ভারত সরকারকে প্রত্যেকেই বলেছেন, কাউকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দীনকে বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে তাকে কিছুই বলা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মীর্জার কথোপকথন নিয়ে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ শীর্ষক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এই ঐতিহাসিক তথ্য স্থান পেয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ কে খন্দকার ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি, বর্তমানে তিনি সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি। মঈদুল হাসান ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের লেখক এবং এস আর মীর্জা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুবশিবিরের মহাপরিচালক।
তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথোপকথনে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টিও বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। এ কে খোন্দকার বলেন, রেডিও কর্মীদের প্রচেষ্টায় ২৬ মার্চ দুপুর ২টার সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অবশ্য মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথমেই যে ঘোষণাটি দেন, সেটি ভুলভাবে দেন। সেই ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। ২৬ মার্চ দুপুরে স্বাধীনতার ঘোষণা এম এ হান্নান সাহেব যেটা পড়েছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া যেটা পড়েন, তার মধ্যে কিন্তু একটা পার্থক্য ছিল। ২৬ মার্চেরটা অনেকে শুনতে পাননি। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও জানি যে, মেজর জিয়ার এ ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামলো। জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
মঈদুল হাসান বলেন, অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে আমি নিজে মনে করেছিলাম যে, না, সত্যি তাহলে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এটা আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আমি উত্সাহিত বোধ করি। আমি আশপাশে যাদের চিনতাম, তারাও এই ঘোষণায় উত্সাহিত হন। সুতরাং জিয়ার সেই সময়টুকুর সেই অবদান খাটো করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এস আর মীর্জা বলেন, ২৫ মার্চের পর আমি সবসময় রেডিও সঙ্গে রেখেছিলাম। এম এ হান্নান সাহেবের ঘোষণাটি আমি শুনিনি। ২৭ মার্চ বিকালে পরিষ্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, হ্যাঁ, এখন মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ, তাদের সঙ্গে বাঙালি সেনারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন এ নিয়ে কোনো কথা কেউ উত্থাপন করেননি বা বিতর্ক হয়নি। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনকালেও এ ব্যাপারে কথা ওঠেনি। এটা শুরু হলো সম্ভবত ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কয়েক বছর পর। ১৯৯১ সালে বিএনপি নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ জিয়াকে খাটো করার চেষ্টা করে। এরপর থেকেই বিবাদটা প্রকট আকার ধারণ করে।
তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথোপকথন হুবহু নিচে দেয়া হলো :
মঈদুল হাসান : বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে, এ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি।
এ কে খোন্দকার : আসলে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোনো রকম আলোচনা কিংবা দ্বিমত কিংবা বিভাজন মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু ছিল না। এটা শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আক্রমণ করল, সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়। তাহলে কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার ঘোষণাটা কীভাবে এলো? ২৬ মার্চ তারিখে সারাদেশেই সান্ধ্য আইন ছিল। চট্টগ্রামে সেই সান্ধ্য আইনের মধ্যেও সেখানকার বেতার কেন্দ্রে কিছু বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে কয়েকজনের নাম আমার মনে আছে—তখন তাঁদের ঠিক কার কী পদ ছিল এখন আমার মনে নেই। তাঁরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে কিছু না কিছু বেতারে বলা দরকার। তখন তাঁরা সবাই মিলে একটা স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া তৈরি করলেন এবং সেই খসড়াটি তাঁরা ২৬ মার্চ দুপুর দুইটার সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে নিজেরা তা চালু করে প্রচার করেন। সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান পাঠ করেন। ধারণ করা এই ভাষণ সেদিন পুনরায় সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে প্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে—এমন কথাগুলো ছিল।
এদিকে বেতার কেন্দ্রটি খোলা হয়েছে এবং কার্যক্রম চালু হয়েছে, সুতরাং এটাকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। এ অবস্থায় তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, মেজর জিয়া নামের একজন ঊর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তা ও সৈনিকসহ পটিয়ায় রয়েছেন।
তখন ২৭ মার্চ তারিখে সকাল ১০টার দিকে এইসব বেতারকর্মী পটিয়ায় যান। তাঁরা সেখানে গিয়ে যে আলোচনা শুরু করেন, তাতে কিন্তু ঘোষণার কোনো বিষয় ছিল না। তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে কথা বলতে। তাঁরা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্র রক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন এবং বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি আমার সৈনিক দিয়ে সাহায্য করব।’ এরপর হঠাত্ তাঁদের কারও একজনের মনে হলো যে, যদি এই ঘোষণাটি একজন সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে বেতারে বলানো যায়, তাহলে এর একটা প্রভাব সারাদেশে ভালোভাবে পড়বে। এই চিন্তা থেকেই মেজর জিয়াকে অনুরোধ করা হয়, তিনি এই ঘোষণাটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পড়তে রাজি আছেন কিনা। আমি পরে শুনেছি, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এম আর সিদ্দিকী তখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং এম এ হান্নান সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মেজর জিয়াকে প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হন এবং বেশ আগ্রহের সঙ্গেই রাজি হন। মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণাটি দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। সেই ঘোষণায় তিনি নিজেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণায় সবাই হতবাক হয়ে যান। এমন ঘোষণা তো তাঁর দেয়ার কথা নয়! এরপর তা সংশোধন করা হয়। ঘোষণা আগে থেকেই যেটি তৈরি ছিল, সেটি আবার জিয়ার কণ্ঠে টেপে ধারণ করা হয় এবং সেটি জিয়া পড়েন ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে। এভাবে বঙ্গবন্ধুর নামে এই ঘোষণাটি ২৬ মার্চ দুপুর দুইটা-আড়াইটার দিকে প্রথম পড়া হয় এবং সেদিন বিকাল চারটা-সাড়ে চারটায় তা পুনরায় প্রচার করা হয়। আর ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে জিয়ার কণ্ঠে প্রথম ঘোষণা হয়। এটি হচ্ছে প্রকৃত সত্য ঘটনা।
মঈদুল হাসান : ২৫ মার্চ সন্ধ্যাবেলা, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন চলে যান এ দেশ থেকে, তখন একটা চরম সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার মতো হয়। সবাই ভাবতে থাকেন, তাহলে এখন কী করণীয়। এসময় তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কিছু নেতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে, অর্থাত্ শেখ মুজিবের বাড়িতে সমবেত ছিলেন। সেখানে এক ফাঁকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি টেপরেকর্ডার এবং ছোট্ট একটা খসড়া ঘোষণা শেখ সাহেবকে দিয়ে সেটা তাকে পড়তে বলেন। এ ঘটনা তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে আমার শোনা। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই আমি যখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি, তখন তাজউদ্দীন আহমদকে এ ব্যাপারে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ঘোষণাটা তাজউদ্দীন আহমদের নিজের লেখা। লেখাটা ছিল এমন—পাকিস্তানি সেনারা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এই খসড়া ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়ার পর সেটা তিনি পড়লেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কিছুই বললেন না, নিরুত্তর রইলেন। অনেকটা এড়িয়ে গেলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন তাকে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে; কেননা কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না কী তাদের করতে হবে। এ ঘোষণা কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে।’ শেখ সাহেব তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ এ কথার পিঠে তাজউদ্দীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাত সম্ভবত ৯টার পরপরই ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান।
পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আবদুল মোমিনকে। তিনি ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। আবদুল মোমিন আমাকে বলেন, তিনি যখন ৩২ নম্বরে যান, তখন দেখেন যে তাজউদ্দীন আহমদ খুব রেগে ফাইলপত্র বগলে নিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছেন। ফাইলগুলো তিনি সব সময় সঙ্গেই রাখতেন। ঘোষণা, পরিকল্পনা এবং অন্য জরুরি কিছু কাগজপত্র এর মধ্যে থাকত। তিনি যেখানেই যেতেন, সেটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন, কাছছাড়া করতেন না। তিনি যখন রেগে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন ৩২ নম্বর বাড়ির দরজার বাইরে তাজউদ্দীনের হাত ধরে আবদুল মোমিন বললেন, ‘তুমি রেগে চলে যাও কেন।’ তখন তাজউদ্দীন তার কাছে ঘটনার বর্ণনা করে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু এইটুকু ঝুঁকি নিতেও রাজি নন। অথচ আমাদের ওপর একটা আঘাত বা আক্রমণ আসছেই।’
এরপর ৩২ নম্বর থেকে তাজউদ্দীন তার বাড়িতে ফিরে যান। রাত ১০টার পর কামাল হোসেন ও আমীর-উল-ইসলাম যান শেখ সাহেবের বাড়িতে। শেখ সাহেব তাদের তত্ক্ষণাত্ সরে যেতে বলেন। শেখ সাহেব নিজে কী করবেন, সেটা তাদের বলেননি। সেখান থেকে তারা দু’জন যখন তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে গেলেন, তখন রাত বোধহয় ১১টার মতো হয়ে গেছে। সে সময় পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু হতে যাচ্ছে। ওখানে তারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাজউদ্দীনকে নিয়ে তারা দু’জন অন্য কোথাও যাবেন।
যাই হোক, ওই ঘোষণার খসড়া তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চের কয়েক দিন আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন এ জন্য যে, এমন একটা অনিশ্চিত বা আকস্মিক অবস্থা হতে পারে। তার কথা, আমি আমার ডাইরিতে টুকে রেখেছিলাম ১৯৭২ সালেই। তিনি বলেন, ‘আমীর-উল ইসলাম ও কামাল হোসেন যখন এসে বলল যে, বাড়ি থেকে এখনই সরে যাওয়া দরকার, তখন আমি তাদের বলিনি; তবে আমার মনে হয়েছিল আমার কোথাও যাওয়া উচিত নয়।’ তাজউদ্দীন আহমদ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যেখানে আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা—যাকে এতবার করে বলেছি, আজকে সন্ধ্যাতেও বলেছি, তিনি কোথাও যেতে চাইলেন না এবং তাকে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যে সংক্ষিপ্ত একটা ঘোষণা বা বার্তা টেপরেকর্ডে ধারণ বা ওই কাগজে স্বাক্ষর করার জন্য বলায় তিনি বললেন, এটাতে পাকিস্তানিরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারবে! তিনি এতটুকুও যখন করতে রাজি নন, তখন এ আন্দোলনের কি-ই বা ভবিষ্যত্?’ এদিকে আমীর-উল ইসলামদের সঙ্গে আলাপ শেষ না হতেই চারদিকের নানা শব্দ থেকে বোঝা গেল যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। তারপর তারা তিনজন বেরিয়ে পড়লেন। কামাল হোসেন গেলেন ধানমন্ডি ১৪ নম্বরের দিকে এক অজ্ঞাত উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন যান লালমাটিয়ায়।